

উখিয়া উপজেলার দক্ষিণের গ্রাম গয়ালমারা। এখানেই দাঁড়িয়ে আছে আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থা এমএসএফ (Médecins Sans Frontières) পরিচালিত মা ও শিশু সেবা হাসপাতাল—যা বছরের পর বছর ধরে অসংখ্য দরিদ্র পরিবারের চিকিৎসার ভরসা হয়ে আছে। কিন্তু সম্প্রতি হাসপাতালটি সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা সামনে আসতেই গ্রামজুড়ে শুরু হয়েছে ক্ষোভের ঝড়।
এমএসএফ জানিয়েছে, তারা গয়ালমারা হাসপাতালকে উখিয়া স্পেশালাইজড হাসপাতালে স্থানান্তরের একটি বিকল্প নিয়ে কাজ করছে। সংস্থাটির ভাষ্য, এই পদক্ষেপের উদ্দেশ্য আরও টেকসই স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা এবং শক্তিশালী রেফারেল ব্যবস্থা গড়ে তোলা। একইসাথে, স্থানীয় কমিউনিটির সাথে সংযোগ বজায় রেখে রোগীদের দ্রুত শনাক্ত করে উন্নত চিকিৎসায় পাঠানোর ব্যবস্থাও থাকবে। এমএসএফ বাংলাদেশের হেড অফ মিশন ফ্রাঁসোয়া হ্যাগেট এক লিখিত বিবৃতিতে বলেন, “গয়ালমারা হাসপাতালকে উখিয়া স্পেশালাইজড হাসপাতালে স্থানান্তরের একটি বিকল্প নিয়ে আমরা কাজ করছি। এর লক্ষ্য হলো আরও টেকসই পরিষেবা নিশ্চিত করা এবং শক্তিশালী রেফারেল ব্যবস্থা তৈরি করা। একইসাথে, সম্প্রদায়ের সাথে সংযোগ বজায় রাখতে, রোগীদের শনাক্ত করতে এবং তাদের চিকিৎসার জন্য রেফার করতে এই হাসপাতালটি কমিউনিটির কাছাকাছিই থাকবে। আমরা জাতি, ধর্ম বা রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নির্বিশেষে সব রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করি।”
তবে এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করে সরব হয়েছেন পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী। এক ভিডিও বার্তায় তিনি অভিযোগ করেন, “পালংখালী ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের গয়ালমারা এলাকা থেকে এমএসএফ হাসপাতালটি উখিয়ায় হস্তান্তরের বিষয়টি পালংখালীর জনগণের সাথে শত্রুতামূলক আচরণ। এই ষড়যন্ত্র অব্যাহত থাকলে আমরা সম্মিলিতভাবে লোকালয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অবাধ যাতায়াত প্রতিরোধ করবো এবং পালংখালীতে এনজিও ও আইএনজিও স্বাস্থ্যসেবা ছাড়া অন্য কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হবে।”
তিনি আরও বলেন, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে প্রবেশের পর থেকে পালংখালী ইউনিয়নের সব সেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে—অর্থনীতি, কৃষি, বনজ সম্পদ, এমনকি সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। হাসপাতালটি এখান থেকে সরিয়ে নিলে এলাকার দরিদ্র ও হতদরিদ্র মানুষ আরও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হবে। এম গফুর উদ্দিন চৌধুরীর দাবি, তিনি এমএসএফ কর্তৃপক্ষের সাথে সরাসরি কথা বলে হাসপাতাল না সরানোর অনুরোধ করলেও তাদের আচরণ দেখে মনে হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তে তারা অটল।
উখিয়া প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারন সম্পাদক মোহাম্মদ কমরুদ্দিন মুকুলসহ স্থানীয়রা বলছেন, গয়ালমারা হাসপাতাল কেবল চিকিৎসার জায়গা নয়, বরং জীবন বাঁচানোর শেষ অবলম্বন। এটি চলে গেলে মা ও শিশুর জরুরি সেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। দূরে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার খরচ ও সময় অনেক পরিবারই বহন করতে পারবে না। তাদের আশঙ্কা, হাসপাতাল সরিয়ে নেওয়ার ফলে এলাকার স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি কর্মসংস্থান ও স্থানীয় অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এদিকে কিছু স্থানীয় সচেতন মহলের মতে, উখিয়ায় হাসপাতাল স্থানান্তরের ফলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর শিবিরের বাইরে যাতায়াত আরও সহজ হবে, যা নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলতে পারে। তাদের দাবি, নতুন হাসপাতাল গড়ে তোলার পরিবর্তে বিদ্যমান গয়ালমারা হাসপাতালকেই আধুনিকায়ন করা উচিত—আইসিইউ, সিসিইউ, আধুনিক ল্যাব, পর্যাপ্ত ডাক্তার-নার্স ও ওষুধ সরবরাহের মাধ্যমে।
সব পক্ষের বক্তব্যে স্পষ্ট, এই হাসপাতাল সরানো শুধু একটি অবকাঠামো স্থানান্তরের বিষয় নয়; এটি পালংখালীর মানুষের জীবন, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার সাথে গভীরভাবে জড়িত। এখন প্রশ্ন, আলোচনার মাধ্যমে কি কোনো সমঝোতা আসবে, নাকি গয়ালমারা হাসপাতালের ভাগ্য অনিশ্চয়তার দোলনায় ঝুলেই থাকবে?
পাঠকের মতামত